দার্শনিক রাজার বৈশিষ্ট্য
প্লেটো প্রদর্শিত দার্শনিক রাজার শাসন সক্রেটিসের 'সৎ গুণই জ্ঞান' এ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো, যে ব্যক্তি প্রকৃত ও পূর্ণ জ্ঞানের সন্ধান পেয়েছেন, তিনি জানেন যথার্থ সততা বা পুণ্য কি? প্লেটোর মতে, "যিনি দার্শনিক কেবল, তিনি এসব জ্ঞানের অধিকারী।”
ভুমিকাঃ
অধ্যাপক সেবাইন বলেছেন, "যারা সত্যিকার জ্ঞানী অর্থাৎ যারা জানেন যে, আদর্শ রাষ্ট্রের প্রয়োজন কি এবং কোন পদ্ধতিতে শিক্ষা দান করলে এ প্রয়োজন মিটানোর উপযোগী নাগরিক গঠন করা যায় তাদের হাতে শাসনের ক্ষমতা ন্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রের পরিত্রাণের কোন আশাই নেই।বিষয়ভিত্তিক সঠিক ও সুনির্দিষ্ট বিষয়াবলি নির্ধারণের মাধ্যমে প্লেটো শিক্ষাতত্ত্বকে প্রাথমিক ও উচ্চ পর্যায়ে এ দু'ভাগে ভাগ করেছেন। উভয় পর্যায় থেকে যারা কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হবেন, তাদেরকে তার পরিকল্পিত আদর্শ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে অভিভাবক শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
অভিভাবক শ্রেণীর সবচেয়ে যোগ্য ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিকে তিনি ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান সুনির্দিষ্ট করে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে দার্শনিক রাজা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
দার্শনিক রাজার বৈশিষ্ট্য
প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র পরিকল্পনায় ক্ষমতার শীর্ষমণি হিসেবে যে দার্শনিক রাজার কথা চিন্তা করেছেন তার মে অবশ্যই এ নিম্নলিখিত গুণাবলি থাকতে হবে:১. দার্শনিক রাজা চরম ও সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী: দার্শনিক রাজা তার প্রজ্ঞা দ্বারা রাষ্ট্র শাসন করার ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ ক্ষমতাশালী হবেন।
২. দার্শনিক রাজা সর্বোত্তম জ্ঞানের অধিকারী: প্লেটোর মতে, "আদর্শ রাষ্ট্রে যতজন নাগরিক থাকবে, তাদের মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থা সম্পাদনের শেষে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিটিই হবেন দার্শনিক রাজা।"
৩. তিনি সৎ ও সুপুজারী হবেন: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে যেসব ঘটনা ঘটবে তাদের মধ্যে যেগুলো সত্য, সুন্দর ও বাস্তু বসম্মত দার্শনিক রাজা সেগুলোকে গ্রহণ করবেন। আর যেগুলো অসত্য সেগুলো তিনি বর্জন করবেন।
৪. তার অন্তর হবে উদার ও মন হবে সংস্কারমুক্ত: মানুষ যত বেশি জ্ঞানী হয় তার মন তত বেশি উদার ও সংস্কারমুক্ত থাকে। দার্শনিক রাজা রাষ্ট্রের বাস্তব প্রয়োজন মোতাবেক একজন উদার ও মননশীল সংস্কারমুক্ততার পরিচয় দিবেন সর্বক্ষেত্রে।
৫. প্রকৃত অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান আহরণের গভীর আগ্রহ: রাষ্ট্রকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হলে মানুষকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষকে দ্বিধাদ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে তুলতে হলে অবশ্যই দার্শনিক রাজাকে বাস্তববাদী হতে হবে।
৬. তিনি নির্লোভ ও অর্থসম্পদের প্রতি তার কোন আকর্ষণ থাকবে না: দার্শনিক রাজার কোন পারিবারিক জীবন থাকবে না। তবে তার জীবনধারণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিতরে তার ব্যবস্থা থাকবে।
৭. তিনি নির্মল চরিত্রের অধিকারী হবেন দার্শনিক রাজার মধ্যে কোন কলঙ্কের ছাপ থাকবে না। তার চরিত্রে থাকবে সংগীতের অমিয় মূর্ছনা এবং স্বভাব হবে স্বর্গীয় দীপ্তির ভাস্কর।
৮. দার্শনিক রাজা আইনের ঊর্ধ্বে প্লেটোর মতে, দার্শনিক রাজা সকল আইনের ঊর্ধ্বে। তিনি ক্ষমতায় বসে আইন মেনে না চললে তাকে বাধ্য করা কারও পক্ষে সম্ভব হবে না। তেমনি তিনি যদি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করেন, তবেও তাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন আইনের প্রয়োজন হবে না।
দার্শনিক রাজার জন্য আইন না থাকলেও প্লেটো তাকে চলার জন্য চারটি মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। যথা:
১. মানুষের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: রাষ্ট্র যেন অতিরিক্ত প্রাচুর্যে ভরপুর না হয় এবং অতিরিক্ত দারিদ্র্যে অভিশপ্ত না হয় এদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য প্লেটো সতর্ক করে দিয়েছেন।
২. মধ্যম প্রকৃতির রাষ্ট্র: রাষ্ট্রের ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে তিনি রাষ্ট্রের সীমারেখা নির্ধারণ করবেন। এ রাষ্ট্র ছোটও হবে না, আবার বড়ও হবে না। অর্থাৎ একটি মধ্যম প্রকৃতির রাষ্ট্র কায়েম করবেন।
৩. সবার কার্যসম্পাদন: শাসক শ্রেণী ন্যায়ের শাসন প্রবর্তন করবেন এবং এটা নিশ্চিত করবে যে, প্রত্যেক নাগরিক ভাদের নির্দিষ্ট কার্যসম্পাদন করে যাবে।
৪. শিক্ষাব্যবস্থার স্থিতিশীলতা: শিক্ষাব্যবস্থায় যাতে কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত না হয়, সেদিকে তিনি খেয়াল রাখবেন।
দার্শনিক রাজার শাসনের কারণগুলো নিম্নরূপ:
১. নির্ধারিত শিক্ষাব্যবস্থা: প্লেটো তাঁর রাষ্ট্রের জ্ঞানী বা অভিভাবক শ্রেণীকে দার্শনিক রাজারূপে গড়ে তুলতে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। এ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে তারা ন্যায় ও প্রকৃত জ্ঞানীর অধিকারী হয়ে দার্শনিক রাজায় পরিণত হতে সক্ষম হবেন।২. গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষ এথেন্সের গণতন্ত্র প্লেটোর নিকট অভিশাপস্বরূপ। কারণ তাঁর শিক্ষাগুরু সক্রেটিস তৎকালীন এথেন্সের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। আর এ কারণেই প্লেটো দার্শনিক রাজাদের দ্বারা শাসনের মাধ্যমে এথেন্স সরকারের স্বরূপ পরিবর্তন করতে চেয়েছেন।
৩. জীবন ও মরণের ভয় নেই: প্লেটোর মতে, "দার্শনিক রাজা মৃত্যুর ভয় করে না। তাঁরা মানবজীবন সম্বন্ধে গভীর চিন্তাভাবনা করেন। তারা সত্যকেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করে।
৪. দার্শনিক রাজার কর্তব্য যে ব্যক্তি যতটুকু পাওয়ার যোগ্য দার্শনিক রাজা তাকে ততটুকু দিবেন। এর বেশি সো আর কিছুই পাবে না। দার্শনিক রাজাদের খুশিমতো রাষ্ট্রীয় সরকার পরিচালিত হবে এবং তারা তাদের কাজের জন্যায় নিজেদের বিবেচনা ছাড়া কারও নিকট দায়ী থাকবে না।
প্লেটোর দার্শনিক রাজার সমালোচনা
প্লেটোর সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অনেকেই অনেকভাবে প্লেটোর দার্শনিক রাজার নীতির সমালোচনা করেছেন। প্লেটোর সমকালীন সোফিস্টগণ, বিশেষ করে সোফিস্টদের শিক্ষাগুরু আইসোক্রেটিস প্লেটোর মতবাদকে অবাস্তব ও কল্পনাবিলাসী বলে আখ্যায়িত করেছেন। নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থা সর্বজনীন নয়: যদিও প্লেটো স্বীকার করেছেন যেসব পিতা-মাতার স্বভাবে রৌপ্য ও তাষ্যের উপাদান রয়েছে, তাদের মধ্য থেকে স্বর্ণের উপাদান সমন্বিত সন্তানের জন্ম হতে পারে। কিন্তু তাঁর 'The Republic' এর আলোচনায় ব্যাপারটিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেন নি।
তাঁর প্রমাণ এ ধরনের সন্তানদের তাদের মূল অংশ থেকে আলাদা করে শাসকের পর্যায়ে উন্নীত করার বিধান সংবলিত কোন পরিকল্পনা তিনি দেন নি। তিনি যে শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেছেন তা শুধু উচ্চতর শ্রেণীর শিশুদের জন্য সংরক্ষিত করে রেখেছেন। কৃষক, শ্রমিক সন্তানদের শিক্ষা সম্পর্কে তিনি কিছুই বলেন নি।
এ থেকে বুঝা যায় যে, তিনি মূলত বিশ্বাস করতেন যে, উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে মহত্তর চরিত্র গঠনে অভিভাবকদের একচেটিয়া ব্যাপার।
২. স্বৈরাচারী শাসনের নামান্তর প্লেটোর দার্শনিক রাজার শাসনের উপর ভিত্তি করে বর্তমান শতাব্দীতে সর্বাত্মকবাদের আবির্ভাব ঘটেছে। তাই অনেকে প্লেটোর দার্শনিক রাজার শাসনকে স্বৈরাচারী শাসনের নামান্তর বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেহেতু দার্শনিক রাজার শাসন কোন আইনের বেড়াজালে সীমিত নয় এবং যে কোন মুহূর্তে তিনি স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারেন।
ফলে জনস্বার্থের নামে স্বেচ্ছাচার চালালে তাতে কারও আপত্তি করার অবকাশ থাকবে না এবং তাতে নিজ স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হতে পারে। ইতিহাস প্রমাণ করে যে, প্রকৃত দার্শনিক রাজার আবির্ভাব কোথাও হয় নি।
৩. শাসিতের প্রতি চ্যালেঞ্জ। প্লেটোর দার্শনিক রাজার শাসননীতি "শাসিতের সমভিত্তিক শাসনব্যবস্থার প্রতি একটা চ্যালেঞ্জস্বরূপ। ফরাসি বিপ্লবের অধিনায়ক বোবেসপিয়ার যেমন জ্যাকোবীনদের ত্রাসের শাসনকে স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে স্বাতন্ত্র্যের স্বেচ্ছাচার বলে অভিহিত করতেন এবং মানুষকে স্বাধীন হতে বাধ্য করার জন্য সে স্বেচ্ছাচারকে কাজে লাগানো হচ্ছে বলে দাবি করতেন।
প্লেটোর দার্শনিক রাজার শাসনও ছিল অনেকটা সে ধরনের ব্যাপার। এছাড়া প্লেটোর দার্শনিক রাজার শাসননীতিতে সাধারণ মানুষের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের যোগ্যতাকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয়েছে। ফলে গণতন্ত্রের যে আন্দোলন পরবর্তী কালে গণমনকে অনুপ্রাণিত করে তা প্লেটোর এ তত্ত্বে অস্বীকৃত হয়েছে।
৪. গণতন্ত্র বিরোধী। প্লেটোর দার্শনিক রাজস্ব শাসিত শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক নয় কারণ তিনি গণতন্ত্রকে নিকৃত শাসনব্যবস্থা বলে মনে করেন। বর্তমানে গণতন্ত্র একটি উত্তম শাসনব্যবস্থা। এজন্য দার্শনিক রাজার শাসিত শাসনব্যবস্থা কখনও উত্তম হতে পারে না।
৫. অবাস্তব: একজন ব্যক্তি কখনও সবগুণের অধিকারী হতে পারে না। এজন্যই নির্দোষ ও নিষ্পাপ ব্যক্তি শাসন প্রতিষ্ঠা করার ধারণা সম্পূর্ণ অবাস্তব এবং কাল্পনিক।
৬. জবাবদিহিমূলক নয়। প্লেটোর দার্শনিক রাজার শাসন দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক নয়। দার্শনিক রাজারা তাদের ইচ্ছামতো শাসন পরিচালনা করবেন এজন্য কারও কাছে তার কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে না।
৭. জনগণের মতামত উপেক্ষিত: দার্শনিক রাজার শাসনে জনগণের মতামতের প্রাধান্য দেয়া হয় না। যে কোন উত্তম শাসনব্যবস্থায় জনগণের মতামতের প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং অধিকার রক্ষা করা হয়। কিন্তু দার্শনিক রাজার শাসনে যেহেতু জনগণের মতামত উপেক্ষিত যেহেতু এখানে জনগণের অধিকারও রক্ষিত হয় না।
৮. শাসক ও শাসিতের মধ্য ব্যবধান দার্শনিক রাজার শাসনে রাজা তার ইচ্ছামতো শাসনকার্য পরিচালন করে এবং জনগণের মতামতের কোন প্রাধান্য দেওয়া হয় না এজন্য শাসক ও শাসনের মধ্যে একপ্রকার ব্যবধান সৃষ্টি হয় যা কোন শাসনব্যবস্থায়ই কাম্য নয়।
৯. আইনের শাসনের অনুপস্থিত: প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রে আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে নি। তিনি দার্শনিক রাজাকেই আইনের উৎস হিসেবে অভিহিত করেন। কিন্তু আইনের শাসন কখনও একজনের কথামতো চলতে পারে না। মূলত প্লেটো দার্শনিক রাজাকে আইনের উৎস ও নিয়ন্ত্রক মনে করে আইনের শাসনকে উপেক্ষা করেছেন।
১০. শ্রেণীবৈষম্য সৃষ্টি: প্লেটো তার দার্শনিক রাজাকে আদর্শ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে স্থান দিয়েছেন সেটা ক্ষমতা, শিক্ষা সবদিকই, এভাবে তিনি যেমনিভাবে উৎপাদক শ্রেণী তথা সাধারণ মানুষকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করেছেন। তেমনিভাবে বৈষম্য সৃষ্টি করে সমাজে শ্রেণীবৈষম্য ও শ্রেণীসংগ্রামের সৃষ্টি করেছেন।
উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, প্লেটোর দার্শনিক রাজার শাসন যদিও কিছুটা সমালোচনার সম্মুখীন, তথাপিও তাঁর এ তত্ত্ব সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যবাহী। Prof. Suda তাঁর 'A History of Political Thought' গ্রন্থে বলেছেন, "প্লেটোর সকল তত্ত্বমালার মধ্যে এটিই হচ্ছে সর্বাপেক্ষা মৌলিক ও তাৎপর্যবাহী অবদান।"
গণতন্ত্র সম্পর্কে প্লেটোর ধারণা
প্লেটোর মতে, আদর্শ রাষ্ট্রের আদর্শ বিচ্যুতির তৃতীয় পর্যায়ে যে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় তাকে বলা যায় গণতন্ত্র (Democracy)। ধনিকতন্ত্রের দারিদ্র্যক্লিষ্ট জনগণ বিত্তশালীদের শোষণ থেকে নিজেদের মুক্ত করে অবাধ স্বাধীনতা ভোগের আশায় একদিন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ধনীদেরকে উচ্ছেদ করে নিজের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।স্বাধীনতার জন্য অধীর আগ্রহ থেকে এ সরকারের জন্ম হয়, কিন্তু স্বাধীনতা বেশিদিন তার নির্মলতা বজায় রাখতে পারে না, অচিরেই তা উচ্ছৃঙ্খলতায় পরিণত হয় এবং সারা দেশব্যাপী নৈরাজ্যের দুঃসহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। গণতান্ত্রিক শাসনে ব্যক্তির উদগ্র স্বাধীনতা লিন্দা সারা দেশকে অন্তর্ধন্দ্ব ও কলহবিবাদে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলে।
বস্তুত 'The Statesman' গ্রন্থে প্লেটো সরকারের নবতর শ্রেণীবিভাগ করেছেন। আদর্শ রাষ্ট্রের বিচ্যুতির ফলে ক্রমানুসারে রাষ্ট্রগুলোকে উচ্চাভিলাষতন্ত্র (Timocracy), কতিপয়তন্ত্র (Oligarchy), গণতন্ত্র (Democracy) ও স্বৈরতন্ত্র (Tyranny) এভাবে ভাগ করেছেন। উক্ত গ্রন্থে তিনি এ শ্রেণীবিভাগকে সম্প্রসারণ করেছেন।
আইন মান্যকারী রাষ্ট্রসমূহে আইনের মাধ্যমে জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। শাসনকর্তাদের সংখ্যানুসারে রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীবিভাগ হচ্ছে ঃ যথাক্রমে একজনের শাসন রাজতন্ত্র, কয়েকজনের শাসন কতিপয়তন্ত্র এবং বহুজনের শাসন উত্তম গণতন্ত্র।
অন্যদিকে, আইনহীন রাষ্ট্রের শ্রেণীবিভাগ দাঁড়ায় যথাক্রমে একজনের শাসন স্বৈরতন্ত্র, কতিপয়ের শাসন ধনিকতন্ত্র এবং বহুজনের শাসন চরম গণতন্ত্র।
উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সামগ্রিকভাবে প্লেটোর চিন্তাধারা ও দর্শনের পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তাঁর সমসাময়িক কালের অপরাপর দার্শনিকদের চিন্তার প্রভাব পড়েছে তাঁর উপর। তাঁর দর্শনে অধ্যাত্মবাদীদের ধারণা প্রকৃতপক্ষে দার্শনিক পিথাগোরাসের কাছ থেকে এসেছে। পার্মানাইডসের দর্শন থেকে তিনি শিক্ষা লাভ করেন যে, পরমসত্তা হলো চিরায়ত।
অন্যদিকে, হিরাক্লিটাস ছিলেন গণতন্ত্রবিরোধী। প্লেটো নিজে ছিলেন ভাববাদী (Idealist) দার্শনিক। তিনি সক্রেটিসের মৃত্যু ঘটনা এবং তৎকালে এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে বিরামহীন যুদ্ধাবস্থা তাঁকে আদর্শ রাষ্ট্রের কথা,
ন্যায়নীতির কথা ভাবায় এবং গণতন্ত্রবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলে। প্লেটো মনে করতেন যে, প্রত্যয়ের বা ভাবের যে জগৎ আছে তা ত্রুটিহীন। দৃশ্যমান জগৎ ছিল তাঁর কাছে তুচ্ছ ও অবহেলার বস্তু।
প্লেটোর জ্ঞানতত্ত্ব
প্লেটো তাঁর 'রিপাবলিক' গ্রন্থের ষষ্ঠ পুস্তকের শেষের দিকে এবং সমগ্র সপ্তম পুস্তক জুড়ে 'জ্ঞান' সম্পর্কে আলোকপাত করেন। এদিক দিয়ে সপ্তম পুস্তককে প্রধানত উচ্চতর দর্শন বা যথার্থ জ্ঞান কাকে বলে তার আলোচনার পুস্তক বলা চলে।প্লেটোর বিখ্যাত ভাববাদ তাঁর জ্ঞান মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রশ্ন জাগে, জ্ঞান কি? সত্য বলতে আমরা কি বুঝি? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর সাধারণত দু'ভাবে দেওয়া যায়। নিষেধমূলক বা নঞর্থকভাবে (Negative) ও সদর্থক বা বিধিমূলক (Positive) ভাবে। প্লেটো নিষেধমূলক বা নঞর্থক দিকটাই বেছে নেন।
তাঁর নিজস্ব মত ব্যাখ্যার পথ সুগম করার জন্য প্লেটো প্রথমে তাঁর পূর্ববর্তী সোফিস্টদের জ্ঞান বিষয়ক ভ্রান্ত মতাবলি খণ্ডন করেন। ভ্রান্ত ও অসত্য মতবাদগুলোকে যুক্তির দ্বারা খন্ডন করে প্লেটো তাঁর এই পরিপ্রেক্ষিতে জ্ঞান মতবাদের সুস্পষ্ট ভূমিকা প্রস্তুত করেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে অনুভূতি এবং ইন্দ্রিয় সাপেক্ষ জ্ঞান যে ভ্রান্ত ও মিথ্যে তা প্রদর্শন করতে গিয়ে তিনি যে যুক্তির অবতারণা করেন তা এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
১. ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণই জ্ঞান (Knowledge is Perception): প্রোটাগোরাস ও সফিস্টদের এ মতবাদ প্লেটো সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। ব্যক্তিবিশেষের কাছে যা সত্য তাই তার কাছে সত্য, ব্যক্তিবিশেষের কাছে যা মিথ্যে তাই তার নিকট মিথ্যা; এটি মেনে নিলে আমাদের ভবিষ্যৎ ঘটনাবলির উপর যথোপযুক্ত প্রয়োগ একেবারে মিথ্যে হয়ে যায়।
কোন একজন ব্যক্তির কাছে মনে হতে পারে যে তিনি আগামী বছর প্রধান বিচারপতি হবেন; কিন্তু প্রকৃতভাবে এখন তিনি জেল খানায় আবন্ধ। ব্যক্তিবিশেষের নিকট ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যা সত্য মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে কার্যত তা প্রায়শই হয় না।
২. প্রত্যক্ষণ অনেক সময় পরস্পর বিরোধী ধারণা সৃষ্টি করে থাকে (Perception yields contradictory impressions): একই বস্তু দূর থেকে ছোট এবং কাছ থেকে বড় বলে মনে হয়। রেল লাইনের দিকে তাকালে নূরদৃষ্টিতে মনে হয় তা মিলিয়ে যাচ্ছে। আসলে কি তাই? কিন্তু বস্তুটি বা রেল লাইনের ব্যবধানটি ঠিক তেমনটিই আছে। অর্থাৎ বস্তুটি আসলে যা আছে তাই।
আবার তুলনামূলকভাবে একই বস্তু হালকা ও ভারি মনে হয়। একই আলোকে একটা জিনিসকে সাদা, অন্যটিকে সবুজ, আবার অন্ধকারে এর কোন রূপই লক্ষ্য করা যায় না। এখন এগুলোর কোনটি সত্য? যুক্তির ভিত্তিতে বলা যায় জ্ঞান যদি অনুভূতি হয় তবে এক অনুভূতিকে অপর অনুভূতির চেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার কোন অধিকার আমাদের নেই।
কারণ, সব অনুভূতিই সমান এবং সবই সত্য। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এবং বাস্তবে তা স্বীকার করে নিতে পারি না
৩. এ মতবাদ শিক্ষা দর্শন আলোচনা ও প্রমাণাদিকে এক ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে (This doctrine renders all teaching, all discussions, proof, or disproof impossible): জান আর অনুভূতি যদি এক হতো তাহলে যে কোন ধরনের আলোচনা, কোনকিছু প্রমাণ করা, কাউকে কিছু শিক্ষা দেওয়া অসম্ভব হয়ে যেত।
যেমন- সব অনুভূতি একইভাবে সত্য হলে একটি শিশুর অনুভূতি ও তাঁর শিক্ষকের অনুভূতির মাঝে কোন পার্থক্য থাকতে পারে না। যেহেতু অনুভূতিতে পার্থক্য নেই, অতএব শিশুর শিক্ষক শিশুকে নতুন কিছু শিক্ষা দিতে পারে না। দর্শনের আলোচনা এবং প্রমাণের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য।
কোনকিছু নিয়ে যদি দু'জন লোকের মধ্যে একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তাহলে বুঝতে হবে তারা বহির্জগতে এক বাস্তব সত্যে বিশ্বাসী। তাদের দু'জনের যদি বিরোধপূর্ণ মতামত হয়, তাহলে দু'টি বিরোধ মতই সত্য হতে পারে না।
যদি দু'টি বিরোধী মত সত্য হতো তাহলে দ্বন্দ্বই থাকতে পারে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাস্তবে তা হয় না। ব্যক্তির অনুভূতি-সংবেদন বহির্জগতের সমগ্র বাস্তবতা ও শিক্ষাকে এক বিরাট ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে।
৪. অনুভূতি যদি সত্য হয় এবং ব্যক্তিমানুষই বস্তুর মূল্য নির্ধারক হয় তবে মানুষ একটা অনুভূতিশীল প্রাণী বৈ আর কিছু নয় (If perception is truth, man is the measure of all things, in his character as a অতএব এ যুক্তিতে নিম্নস্তরের একটা মানুষের মতো বস্তুর মূল্য নির্ধারক।
৫. প্রোটাগোরাসের মতবাদ স্ব-বিরোধাত্মক (The theory of Protegra's contradicts itself): আমার নিকট যা সত্য তাই যদি সত্য হয় তবে যুক্তি অবতারণা করে বলা যায় যে, আমার নিকট এটাও সত্য বলে প্রতীয়মান হয় যে, প্রোটাগোরাসের মতবাদ মিথ্যে। তাহলে প্রোটাগোরাসও স্বীকার করে নিতে বাধ্য থাকবেন যে তা মিথ্যে।
৬. এ মতবাদ সত্যের বস্তুগত সত্যকেই বিনাশ করে দেয় এবং সত্য-মিথ্যা পার্থক্যকে সম্পূর্ণ অর্থহীন মনে করে একই বস্তু একই সময়ে সত্য-মিথ্যা উভয়ই। আমার জন্য যা সত্য অপরের নিকট তাই আবার মিথ্যা। একই জিনিসকে একই সময়ে সত্য-মিথ্যা বলে অভিহিত করা নিছক অর্থহীন।
৭. আসলে সব অনুভূতিতে এমন একটা বিশেষত্ব আছে, যা ইন্দ্রিয়ভুক্ত নয় (In all perception there are elements which are not contibuted by the senses): আমি মনে করি, 'কাগজ খন্ডটি সাদা' একথা বললে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, ইহা কেবল ইন্দ্রিয়ভুক্ত এক বাক্য। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। 'কাগজ খণ্ডটি সাদা' বলার সাথে সাথে আমাদের প্রথমত, কাগজ খণ্ডটির কথা চিন্তা করতে হয়।
তারপর আমরা তাকে একটা বিশেষ শ্রেণীভুক্ত করি। কাগজ খন্ডটিকে আমরা কাগজ খণ্ড বলি, অন্যকিছু বলি না। অন্যান্য কাগজ খন্ডের সাথে তুলনা করে আমরা এটাকে 'কাগজ' শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করি। এখানে দেখা যায়, আমাদের চিন্তার সাথে দু'টি জিনিস বিশেষভাবে জড়িত থাকে।
প্রথমত, তুলনা (Comparison) দ্বিতীয়ত, শ্রেণীকরণ (Classification)। আসলে বস্তু হলো কতকগুলো অনুভূতি বা সংবেদন গুণের সংমিশ্রণ। কাগজ খণ্ডটিকে আমরা কাগজ খণ্ড বলে জানতে পারি তখনই যখন আমরা কাগজের সংবেদন গুণগুলোকে বুঝতে পারি। এখানে আমরা একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারব যে, এই সংবেদন গুণগুলোর সাথে আমরা পূর্বে পরিচিত ছিলাম।
আমরা যে কেবল সংবেদনের সাদৃশ্য গুণগুলোকেই বুঝতে পারি তা নয়। এর সাথে সংবেদনের বৈসাদৃশ্য গুণগুলোকেও আমরা সুস্পষ্টভাবে শনাক্ত করতে পারি। কাগজ খন্ডের অনুভূতিকে আমরা কাষ্ঠ খন্ডের সংবেদন থেকে আলাদা করতে শিখি এবং এ দু'টি সংবেদন আমাদের মনের মাঝে কোন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে না।
কাগজ খণ্ডটি জানার পূর্বেই সংবেদনের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য ধারণা আমাদের ইন্দ্রিয়ভুক্ত কোনকিছু নয়, এটি সম্পূর্ণ ইন্দ্রিয় বহির্ভূত এক ধারণা। মানুষের বিচার-বুদ্ধি, প্রজ্ঞা এবং জ্ঞানই এ ধারণাটুকুকে বস্তুতে রূপান্তরিত করে। সমস্ত ইন্দ্রিয়ানুভূতি জ্ঞানের ঊর্ধ্বে। মানুষের প্রজ্ঞা এখানে বস্তু পরিচিতিতে এক প্রধান ভূমিকা পালন করে।
লেখকের শেষ কথাঃ
অতএব, জ্ঞান বলতে প্রকৃতপক্ষে প্রোটাগোরাসের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে বুঝায় না, জ্ঞান বলতে ইন্দ্রিয় বহির্ভূত প্রজ্ঞারও ভূমিকা রয়েছে যা অতি সামান্য বস্তুতেও এ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ইন্দ্রিয়ানুভূতির মাধ্যমে জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়।যথার্থ জ্ঞানের বিষয় এক অতীন্দ্রিয় ভাবলোকে বিদ্যমান। ইন্দ্রিয়ের সমস্ত দ্বার রুদ্ধ করে দিলেও জ্ঞান উৎসারিত হয়।অর্থাৎ, জ্ঞান হলো মুখ্যত উপলব্ধি ও নিবিড় মননের ব্যাপার।জ্ঞান যদি ইন্দ্রিয়ানুভূতির মতো না হয়, তবে তা ধারণার মতো (If Knowledge is not the same as perception, neither is it, on the other hand, the same as opinion)জ্ঞানই ধারণা, এ মতবাদের বিরুদ্ধে প্লেটো তাঁর দ্বিতীয় প্রয়াস চালান। ভুল ধারণা যেমন জ্ঞান নয়, তা সর্বজন স্বীকৃতও নয়।
সঠিক ধারণাগুলোকেও ঠিক প্রকৃত জ্ঞান বলা চলে না। যেমন- আমরা অনেক সময় এমন ধারণা পোষণ করে থাকি যা ভিত্তিহীন হলেও সত্য হয়ে থাকে। যেমন- কোন যুক্তি প্রমাণ ছাড়া যদি বলি আগামীকাল শিলাবৃষ্টি হবে এবং বাস্তবিক কাল বৃষ্টিই হয়। কিন্তু এ ধারণাটি প্লেটোর মতে জ্ঞান নয়।
কারণ, জ্ঞান বলতে শুধু বিষয়টি কি শুধু তা জানলেই চলবে না, তা অন্য রকম না হয়ে কেন এমন হলো তা জানা আবশ্যক। অর্থাৎ প্রজ্ঞা দিয়ে বস্তুকে পরোপরি জানার নামই জ্ঞান।

বিপ্লব আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রত্যেকটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়
comment url